সোনাদিয়া দ্বীপ। এই নাম শুনলেই মনে হয়, কি আছে এমন এই দ্বীপে? এলেই বুঝতে পারবেন, প্রকৃতিপ্রেমিকেরা কেন এখানে এসে মজা খুঁজে পায়! সোনাদিয়া দ্বীপ সম্পর্কে ফেসবুক এবং গুগলে অনেক তথ্য পাবেন। কিন্তু এক এক জনের অভিজ্ঞতা আলাদা। অন্যদের অভিজ্ঞতা শুনে লাভ নেই। নিজে না গেলে তার স্বাদ কখনো পাবেন না!
আমি একজন ভ্রমণ প্রেমিক, তাই কিছুদিন পর পর ভ্রমণে যেতে হয়। ভ্রমণে যেতে না পারলে একটা অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। অনেকদিন প্ল্যান করার পরও কোন বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে ভ্রমণে যেতে পারছিলাম না, কারণ বন্ধুদের সাথে সময় মিলানোটা এখন কষ্টসাধ্য। সবাই ব্যস্ত জীবনে প্রবেশ করেছে।
তাই ভাবলাম, কিভাবে ট্যুর দেওয়া যায়। ফেসবুকে কিছু গ্রুপ বাংলাদেশের নানা জায়গায় ভালো কিছু ট্যুরের আয়োজন করে। তাদের গ্রুপ গুলো চেক করি। কিছুক্ষণ দেখার পর সোনাদিয়া দ্বীপের ইভেন্ট চোখে পড়ে। আর চিন্তা না করে সঙ্গে সঙ্গে অগ্রিম টাকা দিয়ে বুকিং কনফার্ম করি। গ্রুপের সাথে এবার আমার প্রথম ট্যুর। তাই অনেক কিছুই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। যেমন, গ্রুপের সকলের সাথে মানিয়ে নিতে পারব কিনা। এমন নানান চিন্তাধারা মাথায় ঘুরছে।”
সকল চিন্তাধারা মাথায় রেখে, আগের দিন রাতে আমি আমার ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে রাখি পরের দিনের জন্য ট্যুরে। আগের দিন রাত মানে স্বাভাবিক ঘুম কম হবে পরের দিন ট্যুরে যাওয়া আগ্রহে এপাশ ওপাশ করে রাতটা কাটিয়ে ভোর পাঁচটায় উঠে গেলাম। রেডি হয়ে সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা চেক করে করেই ৫:৩০ এ বেরিয়ে পড়লাম। সকাল সকাল তাই গাড়ি পাওয়াটা অনেক কষ্টসাধ্য। আমারই যেন দেরি না হয়ে যায় আর আমি বাস কাউন্টারে গিয়ে পৌঁছে দেখি কেউ এখনো আসেনি। আমি প্রথম। এরপর একটু নিশ্চিত হওয়া গেল – আমার জন্য কারো দেরি হয় নাই। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর একে একে সবাই আসতে লাগলো। এর মধ্যে আমাদের টিম লিডার ফোন করে বলল আমি এসে পৌঁছেছি কিনা। এবং সকলে আসলে আমরা নাস্তা করতে যাব। সকল টিম মেম্বার আটটার মধ্যে উপস্থিত হন এবং সকলে মিলে নাস্তা করি।
নাস্তা করার সময় তেমন কারো সাথে পরিচিত হতে পারলাম না কারণ সকলেই মাত্র আসলো। এখন পালা সকলেই গাড়িতে ওঠার। পরে আমাদের টিম লিডার আমাদের নির্দিষ্ট সিট দেখিয়ে দিল এবং সকলকে মিলে বসে যেতে বলল। সিট বাছাই করতে গিয়ে দেখি ভদ্রলোক সিটের এক পাশে বসছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম আপনার সাথে কি আর কেউ আছে? তিনি আমাকে বললেন না, আমি চাইলে বসতে পারি। সঙ্গে সঙ্গেই আমি বসে গেলাম। কিছুক্ষণ বসার পর চিন্তা করি কিভাবে তার সাথে পরিচিত হওয়া যায়। কিছু জিজ্ঞেস করলে কিছু মনে করবে নাকি? আমি তাকে কিছু কথা জিজ্ঞেস করে বসলাম। উনার সাথে পরিচিত হয়ে যা বুঝলাম, উনি একজন ভ্রমণ প্রেমিক। মন চাইলে এরকম একা বা কোন ট্যুরিস্ট গ্যাং এর সাথে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে। আমাকেও বলে আমি কি ঘোরাঘুরি করতে পছন্দ করি কিনা। আমি আমার ঘোরাঘুরি আগ্রহ নিয়ে ছোট করে বললাম এবং উনার কাছ থেকে ভ্রমণ নিয়ে অনেক তথ্য জানলাম। কথা বলতে বলতে আমরা চলে এসেছি কক্সবাজার।
সকলেই গাড়ি থেকে নেমে পরে। এরপরে আমাদের পরের গন্তব্য কক্সবাজার ডলফিন মোড় থেকে নাজিরার টেক। এখানে গিয়ে আমরা আমাদের বোটের জন্য অপেক্ষা করি এবং সকলে মিলে আমরা হালকা নাস্তা-পানি করি। এখন আরো কিছু টিম মেম্বারদের সাথে পরিচিত হয়ে নিলাম। সকলের সাথে কথা বলে যা বুঝলাম, সকলেই খুব আন্তরিক। এই জিনিসটা আমার খুব ভালো লেগেছে। এখন আমাদের বোট করে সোনাদিয়া দ্বীপ যাওয়ার পালা। সকলে একে অপরকে সহযোগিতা করে ভোটে উঠে বসি। সময়টা ছিল দুপুর দুইটা। রোদের তাপটাও অনেক বেড়েছে। আশেপাশে নীল জলরাশি, উপরে আকাশ আর ঝাকে ঝাকে পাখির দল আর শীতল বাতাস – সব মিলিয়ে অন্য রকমের অনুভূতি। কিছুক্ষণের এই ভোট জার্নিটাই আপনার সকল ক্লান্তি দূর করে দিতে পারে।



দ্বীপে পৌঁছে আমরা সকলে মিলে দুপুরে খাবারের জন্য প্রস্তুত হই। বলে রাখা ভালো, সোনাদিয়া দ্বীপের তেমন কোন ভালো হোটেল বা রেস্তোরা নেই। যারা আসবেন, সঙ্গে করে সব নিয়ে আসবেন। না হয় স্থানীয় কারো সাথে আগে থেকে যোগাযোগ করে আসবেন। আমাদের টিম লিটার ওখানে আগে থেকেই সব ঠিকঠাক করে রাখে। ক্যাম্পায়ার সোনাদিয়া রিসোর্ট নামের এক ক্যাম সাইটে। খাওয়া-দাওয়া শেষে সকলেই আমরা আমাদের ক্যাম সাইটে বিশ্রাম করি। এখানের শীতল বাতাসটা আপনার মনকে শান্ত করে দিবে। সকলেই যে যার মতন দ্বীপটাকে ঘুরে দেখার জন্য বেরিয়ে পড়ি। এই দ্বীপে রয়েছে ছোট ছোট কিছু গ্রাম। আর আমরা গ্রামের পথ দিয়ে হেঁটে চলি। সন্ধ্যা আগ পর্যন্ত কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করি। ক্যাম্প সাইটে চলে আসি। সন্ধ্যার নাস্তা সেরে সকল টিম মেম্বাররা মিলে গানের আসর আর আড্ডায় মেতে উঠে।



সবাই আড্ডা শেষ করে রাত নয়টা নাগাদ আমরা সকলে সমুদ্র পাড়ে হাঁটতে যাই। সে এক অন্যরকম অনুভূতি! চারিদিকে সমুদ্রের গর্জন, আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। সমুদ্রের পানির ঢেউ যখন পা স্পর্শ করে, সমুদ্রের শীতল পানির সাথে মনটাও শীতল হয়ে যায়। সমুদ্রের পাড়ে অনেকক্ষণ সময় কাটানোর পর সকলেই ক্যাম্পে ফিরে আসি। রাতের খাবার সেরে নিজের ক্যাম্পে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। পরের দিন সকালে আমি সকাল সকাল উঠে পড়ি সমুদ্র পাড়ে সকালটা উপভোগ করার জন্য এবং লাল কাঁকড়া দেখার জন্য। সেই কাজ সেরে সমুদ্রের চড়ে সকালটাকে ভালোভাবে উপভোগ করি। নানান ধরনের ঝিনুক কুড়াই, নানান জাতের মাছ দেখি, আর অসংখ্য লাল কাঁকড়ার দল দেখি। সবকিছু শেষ করে এখন ফিরে যাওয়ার পালা। এখানে কাটানো কিছু মুহূর্ত স্মৃতি হয়ে থেকে যাবে।
আপনি চাইলেও ব্যস্ত জীবন ফেলে কিছুদিন এখানে থাকা সম্ভব না। আবার ফিরে যেতে হবে এই ব্যস্ত নগরীতে। দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততা যখন আমাদের গ্রাস করে ফেলে, তখনই আমরা প্রকৃতির কাছে ছুটে যাই একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে।



সোনাদিয়া দ্বীপের ব্যাপারে আগেই বলেছি, প্রকৃতিপ্রেমিকেরা এখানে তাদের মজা খুঁজে পায়।
অসংখ্য ধন্যবাদ সাকিব নাবিল ভাইকে, চট্টগ্রাম ট্যুরিস্ট গ্যাং এর পক্ষ থেকে এত সুন্দর একটা ভ্রমণের আয়োজন করার জন্য। ১৬ জন সদস্য নিয়ে আয়োজিত ভ্রমণের আগে, আমরা একে অপরকে চিনতাম না। কিন্তু এই দুইদিনে আমরা ১৬ জন একসাথে মিলেমিশে, একটা বড় পরিবার হয়ে উঠেছি। ১৬ জন সদস্যের সবার গল্প এক এক করে বলার সময় নেই! সবাই অসম্ভব আন্তরিক এবং সুন্দর মনের মানুষ।

“আমার নিজের অভিজ্ঞতা এবং অন্যদের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু তথ্য আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করলাম।”
অবস্থান:
সোনাদিয়া দ্বীপ বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোম ইউনিয়নে অবস্থিত। এটি মহেশখালী দ্বীপ থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের কোলে অবস্থিত। সোনাদিয়া দ্বীপ বাংলাদেশের কক্সবাজারের কাছে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত একটি ছোট দ্বীপ। এটি তার আদিম সৈকত, বৈচিত্র্যময় বন্যপ্রাণী এবং নির্মল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত, এটি পরিবেশ-পর্যটক এবং প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে।



কিভাবে যাবেন:
- ঢাকা থেকে:ঢাকা থেকে সোনাদিয়া দ্বীপে যেতে হলে প্রথমে বাস বা ট্রেনে করে কক্সবাজার যেতে হবে। কক্সবাজার থেকে স্থানীয় বাস বা ট্রাক করে মহেশখালী যেতে হবে। মহেশখালী থেকে নৌকা ভাড়া করে সোনাদিয়া দ্বীপে যেতে পারবেন।
- চট্টগ্রাম থেকে:চট্টগ্রাম থেকে বাস বা ট্রেনে করে কক্সবাজার যেতে হবে। এরপর মহেশখালী এবং সোনাদিয়া দ্বীপে যাওয়ার প্রক্রিয়া ঢাকা থেকে একই।
আপনি সেখানে কিভাবে প্রবেশ করব:
সোনাদিয়া দ্বীপ দেখার জন্য আপনাকে কক্সবাজার যেতে হবে, যেটি বাংলাদেশের প্রধান শহরগুলি থেকে সড়ক ও আকাশপথে সু-সংযুক্ত।
লোকাল ট্রান্সপোর্ট: কক্সবাজার থেকে সোনাদিয়া যাওয়ার জন্য নিকটবর্তী মহেশখালী দ্বীপ থেকে নৌকায় যেতে পারেন। নৌকায় চড়ে আশেপাশের জল এবং দ্বীপের মনোরম দৃশ্য দেখা যায
থাকার ব্যবস্থা:
কক্সবাজার: যেহেতু সোনাদিয়া দ্বীপে সীমিত আবাসন সুবিধা রয়েছে, তাই কক্সবাজারে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়, যেখানে বিস্তৃত হোটেল এবং রিসোর্ট পাওয়া যায়।
স্থানীয় ব্যবস্থা: কিছু ক্ষেত্রে, স্থানীয় হোমস্টে বা অস্থায়ী ক্যাম্পিং ব্যবস্থা দ্বীপে উপলব্ধ হতে পারে, তবে আগে থেকে পরীক্ষা করা এবং প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া ভাল।
দর্শনীয় স্থান:
- সোনাদিয়া সমুদ্র সৈকত:সোনাদিয়া দ্বীপের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান হল এর বিশাল সুন্দর সমুদ্র সৈকত। নীল জল, সাদা বালি এবং নারকেল গাছের সমাহার এই সমুদ্র সৈকতকে অপূর্ব করে তোলে।
- ঝিনুকের দ্বীপ:সোনাদিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত একটি ছোট দ্বীপ যা বিভিন্ন রঙের ঝিনুকের জন্য বিখ্যাত।
- ম্যানগ্রোভ বন:সোনাদিয়ার পূর্ব দিকে অবস্থিত একটি বিশাল ম্যানগ্রোভ বন। এই বনে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি এবং বন্যপ্রাণী দেখা যায়।
- আদিনাথ মন্দির: সোনাদিয়া দ্বীপের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি হিন্দু মন্দির।
অন্যান্য আকর্ষণ:
- নৌকা ভ্রমণ: সোনাদিয়ার চারপাশে নৌকা ভ্রমণ করে দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
- মাছ ধরা: সোনাদিয়া দ্বীপ মাছ ধরার জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান।
- সাঁতার কাটা: সোনাদিয়ার সমুদ্র সৈকতে সাঁতার কাটা যায়।
- সূর্যাস্ত দেখা: সোনাদিয়ার সমুদ্র সৈকত থেকে সূর্যাস্ত দেখা অপূর্ব।
ভ্রমণে সতর্কতা ও কিছু পরামর্শ
- নোংরা বা আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলা থেকে বিরত থাকবেন।
- পর্যাপ্ত জল, স্ন্যাকস এবং সূর্য সুরক্ষা বহন করুন।
- আবহাওয়া খারাপ দেখলে আপনাকে অতিরিক্ত সাবধান হতে হবে না হলে অনেক সময় আটকে পড়তে পারেন।
- সাথে পাওয়ার ব্যাংক, টর্চ লাইট রাখুন।
- এখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক সব সময় কাজ করেনা।
- সাতার না জানলে সঙ্গে লাইফ জ্যাকেট নিতে পারেন।
- একজন স্থানীয় গাইড নিয়োগ করা আপনার অভিজ্ঞতা বাড়াতে পারে, এবং নিরাপদ সফর নিশ্চিত করতে পারে।
সকলকে একটাই অনুরোধ, আমরা যেখানেই যাই, সেখানকার পরিবেশকে সুন্দর রাখার চেষ্টা করব!