চট্টগ্রামের ব্যস্ত শহর থেকে মাত্র কিছু দূরে, পাহাড় আর বনের কোলে সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক যা প্রকৃতিপ্রেমী, ট্রেকার ও ঝর্ণা খোঁজার নেশায় থাকা মানুষের জন্য এক পরিপূর্ণ গন্তব্য। এখানকার ঘন সবুজ বন, পাখির ডাক আর ঝিরিপথ ধরে হাঁটলেই আপনি পৌঁছে যাবেন ঝর্ণার মুখোমুখি। বিশেষ করে বর্ষাকালে এখানে যে জলপ্রপাতগুলোর রূপ ফুটে ওঠে, তা দেখলে মন শান্ত হয়ে যায়।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ইকোপার্কে ঢুকতেই মনে হবে “এখানে প্রকৃতি তার সবচেয়ে জীবন্ত রূপে বেঁচে আছে!” পাহাড়ের গায়ে জড়িয়ে থাকা সহস্রধারা আর সুপ্তধারা ঝর্ণা দুটি এখানকার প্রাণ।
কোথায় অবস্থিত?
সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড উপজেলার ফৌজদারহাট বাইপাসের কাছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে অবস্থিত। এটি ‘চট্টগ্রাম বোটানিক্যাল গার্ডেন অ্যান্ড ইকোপার্ক’ নামেও পরিচিত। মূল ফটক পার হয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেই শুরু হয় ট্রেইল আর বনের সৌন্দর্য।
❖ ঝর্ণার পরিচয়: স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য
ইকোপার্কের ভিতরে ঢুকেই চোখে পড়বে বাঁধানো রাস্তা, যা মূলত পার্ক দর্শনার্থীদের জন্য। কিন্তু প্রকৃত ট্রেকিংয়ের মজা শুরু হয় একটু ভেতরে ঢুকে।
- সহস্রধারা (Shohosrodhara): সারা বছর ধরে প্রবহমান। নামের মতোই অসংখ্য ধারায় পাহাড় বেয়ে নেমে আসে। উচ্চতায় প্রায় ৬০ ফুট ।
- সুপ্তধারা (Shuptadhara): বর্ষাকালে জেগে ওঠে (জুন-সেপ্টেম্বর)। শীতকালে প্রায় শুকিয়ে যায়—যেন প্রকৃতির লুকোচুরি খেলা।
🌿 লোককথা: স্থানীয়দের বিশ্বাস, কবি কাজী নজরুল ইসলাম সহস্রধারার পাশে বসে রচনা করেছিলেন “আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ”।


❖ যাত্রাপথ: ঢাকা/চট্টগ্রাম থেকে
- ঢাকা থেকে বাসে:
- সায়েদাবাদ টার্মিনাল থেকে গ্রীনলাইন, সৌদিয়া বা শ্যামলী বাস। ভাড়া ৪০০–১,০০০ টাকা (৫–৬ ঘণ্টা)।
- নামতে হবে সীতাকুণ্ড বাজার। সেখান থেকে অটোতে ফকিরহাট (১০ মিনিট)।
- চট্টগ্রাম থেকে:
- অলংকার মোড় থেকে ভাড়া ৫০–৮০ টাকা (৪৫ মিনিট) ।
❖ ইকোপার্কে প্রবেশ ও অভ্যন্তরীণ রুট
- প্রবেশ ফি:
- পায়ে হেঁটে: ৫০ টাকা
- সিএনজি সহ: ৮০ টাকা।
- ঝর্ণায় যাওয়ার পথ:
১. মূল গেট থেকে ৩ কিমি হাঁটুন ।
২. ২০০+ সিঁড়ি ভাঙলেই চোখে পড়বে সহস্রধারা।
৩. সুপ্তধারা পেতে আরও ১ কিমি পাহাড়ি ট্রেইল।
⚠️ সতর্কতা: বর্ষায় পথ পিচ্ছিল! বাঁশের লাঠি (২০ টাকা) বা হাইকিং শু পরা জরুরি।
❖ অভিজ্ঞতা: যখন ঝর্ণার সামনে দাঁড়ালাম
- সহস্রধারা: জলের ধারাগুলো এতই স্বচ্ছ যে নিচের পাথুরে কুণ্ড স্পষ্ট দেখা যায়। গা ভেজানোর সময় মনে হচ্ছিল—“জীবনের সব ক্লান্তি ধুয়ে যাচ্ছে!”
- সুপ্তধারা: বর্ষায় এর ৩ ধাপবিশিষ্ট পতন দেখে মনে হবে, যেন সাদা পর্দা টানিয়ে রেখেছে পাহাড়।
- বন্যপ্রাণী: রাস্তায় বানরদল, আর দূরে মায়া হরিণের দৌড়াদৌড়ি ।
❖ যাওয়ার সেরা সময় ও টিপস
- মৌসুম:
- ঝর্ণার পূর্ণ রূপ: জুন–সেপ্টেম্বর (বর্ষা)।
- আরামদায়ক ট্রেকিং: অক্টোবর–মার্চ।
- খাবার:
- ট্রেইলে কোনো দোকান নেই! শুকনো খাবার–পানি নিন।
- ফেরার পর সীতাকুণ্ড বাজারের আল-আমিন হোটেলে মাছের ঝোল–ভাত ।
❖ থাকা ও আশেপাশের স্থান
- থাকা:
- সীতাকুণ্ডে: হোটেল সৌদিয়া (৮০০–১,৬০০ টাকা)।
- চট্টগ্রামে: হোটেল প্যারামাউন্ট (৮০০–১,৮০০ টাকা) ।
- কাছাকাছি দর্শন:
- চন্দ্রনাথ মন্দির (৫ কিমি): পাহাড়ের চূড়ায় ১,০০০+ সিঁড়ি!
- গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত (৮ কিমি): নির্জন বেলাভূমি।
❖ দায়িত্বশীল পর্যটন: আমাদের অঙ্গীকার
“প্রকৃতি আমাদের অতিথি; আমরা তার মালিক নই”
- ঝর্ণার পানিতে সাবান/শ্যাম্পু ব্যবহার নিষিদ্ধ।
- প্লাস্টিক বোতল/ময়লা ব্যাগে নিয়ে ফেরুন।
শেষ কথা: কেন যাবেন?
সহস্রধারার অনন্ত ধারা আর সুপ্তধারার রহস্যময়তা আপনাকে শেখাবে—“সৌন্দর্য কখনো শেষ হয় না, শুধু লুকিয়ে থাকে!” শহরের কোলাহল ভুলে এই নির্জনতায় ডুব দিতে একবার হলেও আসুন।