যদি এমন একটি দিন কাটাতে পারেন যেখানে আপনার পাহাড়, ঝর্ণা, প্রকৃতি মিলে তার সৌন্দর্যের হাতছানি দিচ্ছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য জিনিসটা এমন যে, আপনি চাইলেই পাবেন এমন না। সবকিছু উপভোগ করার একটা সময় থাকে। তাই ঝর্ণার সৌন্দর্য উপভোগ করার সময় হচ্ছে বর্ষাকাল। তখন আপনি ঝর্ণার আসল রূপ দেখতে পাবেন। তার পুরো যৌবন নিয়ে ফিরে আসে ঝর্ণা । প্রকৃতি প্রেমীরা সারা বছর মিলে এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করে থাকে, যেমনটা আমি নিজেও এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করে থাকি। প্রতি বছর, সব সময় ট্যুরে যাওয়ার আগে ছোটখাটো একটা ট্যুর প্ল্যান করার দরকার হয়। আর এইসব কাজে আমার আগ্রহ বেশি থাকার কারণে, সারাদিনের মধ্যে কিভাবে সকল কিছু ঘুরে আসা যায় এটার একটা ট্যুর প্ল্যান করি। ট্যুর প্ল্যান তো হলো। এখন মজার বিষয় হচ্ছে, আপনি যাদের সাথে যাবেন…
আমি যখন ট্যুর প্ল্যান করি, আমি আমার সকল বন্ধুদের জানিয়ে দিই। আমি জানি যে সকলেই যাবে না, তবু আমার বলাটা দরকার। প্রথম দিকে সবাই যাওয়ার আগ্রহ থাকলেও, যাওয়ার একদিন আগে আর যাবার আগ্রহ দেখা যায় না। একটা কথা জানিয়ে রাখা ভালো, যাবার এক সপ্তাহ আগে ওখানে তিনজন মারা গিয়েছিল। সকল কিছু জেনেও ওখানে যাওয়া সিদ্ধান্ত নিই। এরকম একটা সময় আমি যদি আমার পরিবারকে জানাতাম এই একই জায়গায় আমি যাচ্ছি, তাহলে কেউ আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিত না। তাই আমি শুধু বলেছি ঝর্ণায় যাচ্ছি। যদি আমার দিদি আগে থেকেই জানত কোথায় যাব, পরিবারকে মিথ্যে কথা বলে কোথাও যাওয়ার আমার পছন্দ না। কিন্তু গত সপ্তাহে ওখানে কি ঘটেছিল, ওটা জানাইনি। কারণ সকলের পরিবারই চাইবে না পরিবারের কোনো সদস্য যেন ট্যুরে গিয়ে হারিয়ে না যায়। আর আমরা যে পাঁচজন গিয়েছিলাম, সবাইকে আমি জানিয়ে দিয়েছিলাম এখানে এরকম ঘটনা ঘটেছিল। আমরা সবাই সবকিছু জেনে গিয়েছিলাম।



যদিও আমার মনে একটু ভয় ছিল যে সবাইকে সুস্থভাবে ট্যুর শেষ করে ফিরিয়ে আনা এবং নিজেও সুস্থ থাকা। পরের দিন সকালে আমরা সবাই বেরিয়ে পড়ি। এখন আমরা মোহরা থেকে সকলে একত্রিত হয়ে একেকজন করে গিয়ে পৌঁছাই। ওখানে সকালের নাস্তাটা করি। এরপর আমরা বাসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। নয়দুয়ারী বাজার যাওয়ার অনেক বাস থাকলেও, দরাদরি করে ভাড়া ঠিক করতে হয়। বাসে উঠে নয়দুয়ারী বাজার পৌঁছে রেল লাইন পার হয়ে কিছুদূর হেঁটে গেলে ট্রেইলে ঢোকার প্রথম গেট পাওয়া যায়। আমরা হেঁটে যাওয়ার সময় পাড়ার অনেক লোক আমাদের সতর্ক করে দিল যেহেতু আমরা যেদিন গিয়েছিলাম, বৃষ্টি পড়ছিল আর বৃষ্টিতে ঝর্ণা ভয়াবহ হয়ে ওঠে। যাওয়ার পথে কিছু ঘরোয়া খাবার হোটেল পেয়ে এখানে আমরা দুপুরের খাবার অর্ডার দিয়ে দিই এবং আমাদের ব্যাগগুলো ওখানে রেখে দিই। ঝর্ণা ট্রেকিং করার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমাদের সাথে নিয়ে নিই।



আপনার থেকে জনপ্রতি ২০ টাকা করে নেবে এবং আপনাদের সাথে একটা গাইড নেওয়ার পরামর্শ দেবে কারণ কিছুদিন আগে একটি ঘটনা ঘটেছে, তাই পর্যটকদের সতর্ক থাকার জন্য গাইড নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। একজন গাইড নিলে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে ঠিক করে নেওয়া হয়। আমাদের অনেক জোরাজুরি করল, কিন্তু আমরা গাইড নিলাম না কারণ আমার আগেই ঝর্ণায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল। আমরা গাইড না নেওয়ায়, উনারা আমাদের ছবি/ভিডিও তুলে রাখেন এবং বলেন, “আপনাদের কোনো কিছু হলে উনারা দায়ী নয়।” এই ধরনের কথা বলে একটি ভিডিও রেকর্ড করলেন।
সবশেষে আমরা প্রবেশ করলাম এবং ঝিরিপথ ধরে ঝর্ণা দেখার জন্য হেঁটে যাচ্ছি। সকলেই পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখে ছবি তোলার জন্য ব্যস্ত। কিছু ছবি এবং ভিডিও ফুটেজ স্মৃতি হিসেবে তুলে নিই। এটি মূলত একটি ঝিরি ট্রেইল। ঝর্ণাগুলোতে যাওয়ার যে ঝিরিপথ রয়েছে, সেটিকে নাপিত্তাছড়া ট্রেইল বলে। এই ঝিরিতে ঝর্ণা, ক্যাসকেড ও খুম আছে। পুরো ট্রেইল হেঁটে দেখতে ৪-৫ ঘণ্টা লাগবে। টিপরা খুম – কুপিকাটা খুম – বাঘ বিয়ানী ঝর্ণা – বান্দরখুম ঝর্ণা এর মূল আকর্ষণ। এক ট্রেইলেই এই সবগুলো দেখতে পারবেননাপিত্তাছড়া ঝর্ণা প্রকৃতিপ্রেমী এবং অভিযাত্রীদের জন্য একটি চমৎকার গন্তব্য। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য এটি একটি আদর্শ স্থান। আমরা সকলেই ট্রেইলটা সুন্দরভাবে শেষ করি।
নাপিত্তাছড়া ঝর্ণার অবস্থান
চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়কের মিরসরাই উপজেলার খৈয়াছড়া ইউনিয়ন অন্তর্ভুক্ত নয়াদুয়ার বাজার এলাকায় এটির অবস্থান। মহাসড়ক থেকে নাপিত্তাছড়া ট্রেইলেই পৌছাতে ৫০-৬০ মিনিটের মত সময় লাগে।
নাপিত্তাছড়া ঝর্ণা যাওয়ার উপযুক্ত সময়
বাংলাদেশের নাপিত্তাছড়া জলপ্রপাত দেখার সেরা সময় হলো বর্ষাকালে, সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর। এই সময়ে, জলপ্রপাতটি তার সবচেয়ে প্রাণবন্ত এবং পূর্ণ প্রবাহে থাকে, যা একটি শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য প্রদান করে। যাইহোক, ট্রেইলগুলি পিচ্ছিল হতে পারে, তাই সঠিক হাইকিং জুতা পরুন এবং অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করুন।
শুষ্ক মৌসুমে (নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি) পরিদর্শন করা এড়িয়ে চলুন, কারণ পানির প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায় এবং জলপ্রপাতটি তার অনেক আকর্ষণ হারাতে পারে।
নাপিত্তাছড়া ঝর্ণা ভ্রমণে সতর্কতা ও কিছু পরামর্শ
- নোংরা বা আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলা থেকে বিরত থাকবেন।
- আবহাওয়া খারাপ দেখলে আপনাকে অতিরিক্ত সাবধান হতে হবে না হলে অনেক সময় আটকে পড়তে পারেন।
- অনেক সময় আটকে পড়া লাগতে পারে উপরে বৃষ্টি হলে। সুতরাং সকাল সকাল উপরে যাওয়ার চেষ্টা করুন।
- ভালো মানের গ্রিপের জুতা পরে যাবেন।
- সাথে পাওয়ার ব্যাংক, টর্চ লাইট রাখুন।
- সাথে লবন নিয়ে আসুন কারন পানিতে জোঁক থাকতে পারে। জোঁক লাগলে ছাড়ানোর জন্য কাজে আসবে।
- জোক থেকে বাঁচতে ঘাস এড়িয়ে চলুন।
- পাহাড়ি রাস্তা তাই কিছু ঔষধ সঙ্গে নিতে পারেন। ব্যান্ডেজ ও ডেটল জাতীয় এন্টিসেপটিক ও নিতে পারেন, কেটে বা ছিলে গেলে কাজে আসবে।
- যেহেতু পাহাড়ে যাচ্ছেন ট্র্যাক করতে হবে, তাই দড়ি নিতে পারলে ভাল।
- সাতার না জানলে সঙ্গে লাইফ জ্যাকেট নিতে পারেন।
- এখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক সব সময় কাজ করেনা।